6/recent

ট্রাম্পের অভিষেক: সমর্থকদের সমাবেশে মাস্কের ‘নাৎসি স্যালুটের’ কারণ কী


 

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় ইলন মাস্কের হাতের ভঙ্গিমা নিয়ে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়েছে। এই ধনকুবেরের ওই ভঙ্গিমাকে অনেকেই হিটলারের নাৎসি বাহিনীর স্যালুটের সঙ্গে তুলনা করছেন।

গত সোমবার ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটাল ওয়ান অ্যারেনায় ট্রাম্পের সমর্থকদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আর সেখানেই হাজির হয়ে ওই বিশেষ ভঙ্গিমা প্রদর্শন করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের মালিক এবং স্পেসএক্স ও টেসলার প্রধান নির্বাহী (সিইও) ইলন মাস্ক।

সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে মাস্ক বলেন, এটি কোনো সাধারণ বিজয় ছিল না। এটি ছিল মানবসভ্যতার পথে চলার এক সন্ধিক্ষণ। তিনি বলেন, ‘এটি ছিল সত্যিই এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটা ঘটতে দেওয়ায় আপনাদের ধন্যবাদ! আপনাদের ধন্যবাদ।’


পরে মাস্ক তাঁর ডান হাত দিয়ে বুকের বাঁ পাশ স্পর্শ করেন; এরপর তালু নিম্নমুখী রেখে তা প্রসারিত করেন। উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশে একই ভঙ্গির পুনরাবৃত্তি করেন তিনি।

মাস্ক তাঁর অদ্ভুত ভঙ্গিমার ইতি টানেন এ–ই বলে, ‘আপনাদের জন্য আমার আন্তরিক সহানুভূতি। মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।’

মাস্কের এই আচরণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দার ঝড় উঠেছে। তাঁরা বলছেন, এটি জার্মানির সাবেক স্বৈরশাসক অ্যাডলফ হিটলারের সমর্থকদের স্যালুটকেই মনে করিয়ে দেয়। তবে এ সমালোচনার নিন্দা জানিয়ে মাস্ক এক্সে লিখেছেন, প্রত্যেকেই হিটলার। এমন আক্রমণ খুবই বিরক্তিকর।

মাস্কের এ ভঙ্গিমা নিয়ে কেনই–বা এত বিতর্কের সৃষ্টি, আসুন জেনে নেওয়া যাক:

মাস্কের স্যালুটের প্রতিক্রিয়া

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ফ্যাসিবাদ বিষয়ের অধ্যাপক রুথ বেন–ঘিয়াট এক্সে লেখেন, ‘এ ভঙ্গিমা নাৎসিদের একটি স্যালুট—এটি খুবই যুদ্ধ মনোভাবাপন্ন ইঙ্গিতও বটে।’

তবে এমন দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে নিউইয়র্কভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন অ্যান্টিডিফেমেশন লিগ (এডিএল)। ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে কাজ করা সংগঠনটি বলেছে, মাস্ক নাৎসিদের ব্যবহৃত স্যালুট দেখাননি; বরং প্রযুক্তির এ সম্রাট উচ্ছ্বাস প্রকাশের এক মুহূর্তে ব্যতিক্রমী অঙ্গভঙ্গি করেছেন।

মাস্কের এ ভঙ্গিমা নাৎসিদের একটি স্যালুট—এটি খুবই যুদ্ধ মনোভাবাপন্ন ইঙ্গিতও বটে।
রুথ বেন-ঘিয়াট, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ফ্যাসিবাদ বিষয়ের অধ্যাপক

এ বক্তব্যকে সমর্থন করে এক্সে বার্তা দিয়েছেন টেনেসির মেরিভিল কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক অ্যারন অ্যাস্টর। তিনি লেখেন, ‘এটি কোনো নাৎসি স্যালুট নয়। এটি ছিল তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশের একটি ভঙ্গি, যা তিনি এমন এক সময় দেখিয়েছেন, যখন বলছিলেন, “আপনাদের জন্য আমার আন্তরিক সহানুভূতি।”’

যাহোক, মাস্কের ওই কর্মকাণ্ড দৃশ্যত নব্য–নাৎসি ও শ্বেত জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে উৎসাহিত করেছে।

রোলিং স্টোন সাময়িকী লিখেছে, নব্য–নাৎসি গোষ্ঠী ‘ব্লাড–ট্রাইব’–এর নেতা ক্রিস্টোফার পোলহস ইলন মাস্কের ভঙ্গিমার দৃশ্য টেলিগ্রামে শেয়ার করে ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘এই ভঙ্গিমা কোনো ভুল হলেও তাতে আমার কিছু আসে–যায় না। আমি এটি আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করছি।’

এ ভঙ্গির পেছনের ইতিহাস

নাৎসি স্যালুট ‘হেইল হিটলার’ স্যালুট নামেও পরিচিত। এ স্যালুটে তালু নিম্নমুখী রেখে ডান হাত পাশে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। জার্মানিতে নাৎসি শাসনামলে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন হিসেবে ব্যবহার করা হতো এটি।

তবে এ ভঙ্গিমা প্রাচীন রোমে ব্যবহৃত একটি অভিবাদনের সময় থেকে শুরু হয়েছে বলে জানা যায়। ইতালির স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনি ১৯২৫ সালে এ ভঙ্গিমার প্রবর্তন করেছিলেন।

এক বছর পর ১৯২৬ সালে জার্মানির নাৎসি পার্টির সদস্যরা এ ভঙ্গির ব্যবহার শুরু করেন। দলটির অভ্যন্তরে এ ভঙ্গির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়।

মাস্কের বিরুদ্ধে অতীতে ইহুদিবিদ্বেষের ব্যাপারে নমনীয়তা দেখানোর অভিযোগ আছে। যেমন ২০২৩ সালে এক্সে প্রকাশিত একটি পোস্টকে অনুমোদন দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। পোস্টে ইহুদিদের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গবিদ্বেষের অভিযোগ করা হয়েছিল। মাস্ক এ দাবিকে সমর্থন করে লিখেছিলেন, ‘এটাই প্রকৃত সত্য’।

নাৎসি স্যালুট কোথায় নিষিদ্ধ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু পর নাৎসি স্যালুট নিষিদ্ধ করে জার্মানি। এ ছাড়া নাৎসিবাদের কোনো প্রতীকী প্রদর্শন তিন বছরের কারাদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়।

বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসি পার্টি ও নাৎসি প্রতীকের বিরুদ্ধে আইন পাস করে অস্ট্রিয়া। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়া নাৎসি স্যালুট ও নাৎসি স্বস্তিকা নিষিদ্ধ করে। এ ছাড়া কানাডা, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডে নাৎসি অঙ্গভঙ্গি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

তবে যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর কারণে এ স্যালুট নিষিদ্ধ নয়। মার্কিন সংবিধানে বাক্‌স্বাধীনতা রক্ষার পাশাপাশি ঘৃণাসূচক বক্তব্য–বিবৃতির বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে।


মাস্ক কি নাৎসি–সংশ্লিষ্টদের সমর্থন করেছেন

মাস্কের বিরুদ্ধে অতীতে ইহুদিবিদ্বেষের ব্যাপারে নমনীয়তা দেখানোর অভিযোগ আছে। যেমন, ২০২৩ সালে এক্সে প্রকাশিত একটি পোস্টকে অনুমোদন দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। ইহুদিদের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গবিদ্বেষের অভিযোগ করা হয়েছিল পোস্টটিতে। মাস্ক এ দাবিকে সমর্থন করে লিখেছিলেন, ‘এটাই প্রকৃত সত্য’।

ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে কাজ করা অ্যান্টিডিফেমেশন লিগ (এডিএল) মাস্কের এ মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছিল। এ মন্তব্যকে ‘খুবই অস্বস্তিকর’ আখ্যা দিয়ে তারা বলেছিল, মাস্ক তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মে ‘অতি বিষাক্ত, ইহুদিবিদ্বেষী প্রচারণা’য় যুক্ত রয়েছেন।

পরে মাস্ক বলেন, তিনি ও তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স সব ধরনের ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন

অবশ্য, মাস্ক জার্মানির অতি ডান অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) পার্টিকে ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে সমর্থন দেন। ২০২১ সালে দেওয়া এক বক্তব্যে দলটির নেতা বিয়র্ন অক ‘এভরিথিং ফর জার্মানি’ বলে মে মাসে জরিমানার শিকার হন। স্লোগানটি নাৎসি আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করতেন। বর্তমানে জার্মানিতে এটি নিষিদ্ধ।

মাস্ক যুক্তরাজ্যের অতি ডান, অভিবাসনবিরোধী দল ‘রিফর্ম ইউকে’কেও সমর্থন দিয়েছেন। গত জুলাই মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে দলটির এক প্রার্থী এক মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েন। তিনি দাবি করেন, তাঁর দেশ হিটলারের ‘অফার অব নিউট্রালিটি’ গ্রহণ করলে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ না নিলে ‘অনেক ভালো’ করত।

ইতালির ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব রয়েছে ইলন মাস্কের। একসময় মেলোনি নব্য–নাৎসি ‘ইতালিয়ান স্যোশাল মুভমেন্ট’–এর তরুণ নেতা ছিলেন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments